সামরিক শাসন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ (১৯৭৫-১৯৯০)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - NCTB BOOK

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে সেনাশাসন বহাল ছিল। দেশের সংবিধানকে উপেক্ষা করে খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আহসান উদ্দিন এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ এ সময়ের মধ্যে অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। দেশে সেনাশাসন বহাল রেখে সুবিধামতো সময়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (১৯৭৫-১৯৮১) এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ (১৯৮২-১৯৯০) নির্বাচন সম্পন্ন করে বেসামরিক শাসন চালু করেন। তাদের অগণতান্ত্রিক শাসন, জনগণের ভোটাধিকার হরণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কার্যকলাপ দেশের জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ফলে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অবসান ঘটে দীর্ঘ সেনাশাসনের। অবশেষে ১৯৯১ সালে পুনরায় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।

এই অধ্যায় শেষে আমরা-

  • সামরিক শাসনের সূত্রপাত এবং পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা বর্ণনা করতে পারব;
  • রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসন আমলের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো বর্ণনা করতে পারব;
  • ১৯৮২ সালের সামরিক শাসন এবং তৎপরবর্তী ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে পারব;
  • এরশাদ সরকারের প্রশাসনিক সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি এবং ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • বাংলাদেশে গণতন্ত্রের তাৎপর্য এবং এর প্রয়োগ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করব।
Content added By
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
এম. এ আনিসের পতন
সত্তর-এর নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল

খন্দকার মোশতাকঃ ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়

মোশতাকের স্বল্পকালীন শাসনকাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া বাংলাদেশের সমস্ত অর্জন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয় এবং পাকিস্তানের ভাবধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠা শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করে পাঁচ দিনের মাথায় মোশতাক স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সামরিক আইন জারি করেন । ১৫ই আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি শুরু করলেন, 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' দিয়ে আর শেষ করলেন, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বলে । ভাষণে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ঐতিহাসিক প্রয়োজন' আখ্যায়িত করে বলেন, ‘.... দেশের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন সকল মহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করেছেন । এটি ছিল মোশতাকের জাতিকে বিভ্রান্ত করার প্রথম প্রয়াস ।

সামরিক বাহিনীর কিছু অবসরপ্রাপ্ত ও বরখাস্তকৃত নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের অফিসারের প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রকে মোশতাক সমগ্র সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান হিসেবে বর্ণনার চেষ্টা করেন। আর এই নিষ্ঠুর বর্বর হত্যাকাণ্ডকে তিনি ‘সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার' বলে অভিহিত করেন । মোশতাক নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন । কেউ কেউ উৎসাহী ছিলেন না, এমন নয়। তবে, জীবনের ভয় দেখিয়েও মোশতাক জাতীয় চার নেতাসহ অনেককে বশীভূত করতে পারেননি। ১৭ই আগস্ট গ্রেফতার হন প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলী। ২২শে আগস্ট গ্রেফতার হন তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ।

কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, কোরবান আলীসহ প্রায় ২০ জন নেতাকে ২৩শে আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। আরও অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, যারা মোশতাকের নেতৃত্ব মানতে রাজি হননি । মোশতাকের এ ঘৃণ্য ও অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে চরমমূল্য দিতে হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে ৩রা নভেম্বর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । কারাগারের ভেতরে ঢুকে নির্মমভাবে জাতীয় চার নেতাকে যারা হত্যা করল, তাদের গ্রেফতার করা হলো না; কোনো বিচার হলো না । বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় যুক্ত হলো । মোশতাক এ সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী নানা প্রতিক্রিয়াশীল উদ্যোগ নেন । যেমন- মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা' বাতিল করে দেন। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ'-এর অনুকরণে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' স্লোগান চালু করেন । রেডিও পাকিস্তানের মতো করলেন ‘রেডিও বাংলাদেশ” ।

মোশতাকের সবচেয়ে নিন্দনীয় ও জঘন্য কাজ হলো ১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট একটি আদেশ জারি । এই আদেশ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না । কোনো সভ্য সমাজে এই ধরনের আইন হতে পারে না যে, হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না । মানবতাবিরোধী এই কালো আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫' নামে ১৯৭৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ গেজেট’- এ প্রকাশিত হয় । ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সরকার পরিবর্তনের জন্য যেসব পরিকল্পনা বা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে এবং যারা এর সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি বিধানের জন্য কোনোরূপ আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। 'শুধু তাই নয়, খন্দকার মোশতাক ১৫ই আগস্টের খুনিচক্রকে দেশে-বিদেশে উচ্চপদ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃতও করেন ।

১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ও তার সহযোগীরা ক্ষমতাকে স্থায়ী ও নিরাপদ করার জন্য সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। এরই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় । ২৫শে আগস্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন মোশতাক । ভারতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় । মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথমরাষ্ট্র পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডে জুলফিকার আলী ভুট্টোর আনন্দের সীমা ছিল না । ভুট্টো খুনিচক্রকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, কারণ এটা ছিল তার কাছে পাকিস্তানের বিজয়, যা ১৯৭১ সালে হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার শামিল । চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যথাক্রমে ১৬ই ও ৩১শে আগস্ট, ১৯৭৫ । জনসমর্থনহীন মোশতাকের অবৈধ সামরিক সরকারের পতন হয় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ।

Content added By

খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান

১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ফলে দেশে চরম রাজনৈতিক শূন্যতার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে দেখা দেয় নৈরাজ্যকর অবস্থা । মোশতাকের পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না । কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সেনাকর্মকর্তা ও সৈনিকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেই মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছেন । তাই এই সৈনিকদের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বঙ্গভবনে অবস্থান করে খুনিচক্র রাষ্ট্রক্ষমতায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এতে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড একেবারে ভেঙে পড়ে । উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের দাবির মুখেও নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেননি । কারণ ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সহায়তায় জিয়া সেনাপ্রধানের পদ লাভ করেছেন । সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া জিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না কিংবা ইচ্ছুক ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে জিয়ার নিষ্ক্রিয়তা সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়িয়ে দেয় । চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর মধ্যে নেতৃত্বের সংকট নিরসনে উদ্যোগী হন । তিনি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন । শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন সামরিক অভ্যুত্থান ছাড়া চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় । কর্নেল সাফায়াত জামিল এই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ১লা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ বিশ্বস্ত কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হন। পাল্টা অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২রা নভেম্বর রাতে বঙ্গভবন থেকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান শুরু হয় । ৩রা নভেম্বর ভোররাতে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয় । খালেদ মোশাররফের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল নিয়ে খন্দকার মোশতাকের দেনদরবার চলতে থাকে। একপর্যায়ে জেনারেল ওসমানীর পরামর্শে ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের খুনিচক্র পরিবার-পরিজনসহ ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যায় । ৪ঠা নভেম্বর সকালে খালেদ মোশাররফ বর্বর, নৃশংস জেলহত্যার কথা জানতে পারেন ।

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর গভীর রাতে দেশত্যাগের পূর্বে ঘাতকের দল প্রেসিডেন্ট মোশতাকের অনুমতি নিয়ে বেআইনিভাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে বন্দি অবস্থায় থাকা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে । মোশতাক নানা ভয়ভীতি দেখিয়েও জাতীয় চার নেতাকে তার সরকারের মন্ত্রিপদ গ্রহণে সম্মত করাতে পারেননি । যে কারণে খুনিচক্র কারাগারের ভেতরে এ রকম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটাল । এ হত্যাকাণ্ড ছিল '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সম্মিলিত ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার বাস্তবায়ন । উভয় হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ ধ্বংস, দেশকে নেতৃত্বশূন্য এবং পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা । ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড একই গোষ্ঠী সংঘটিত করে।

৪ঠা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ এক ঘোষণায় জানালেন যে, জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন । তিনি মোশতাকের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন তাকে পদোন্নতিসহ সেনাপ্রধান নিয়োগের জন্য । ক্ষমতার পালাবদলে মোশতাককে সম্মত করাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় । শেষ পর্যন্ত ৫ই নভেম্বর মাঝরাতে মোশতাক ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন । এই পরিস্থিতিতে খালেদ মোশাররফ ও অভ্যুত্থানকারী অফিসাররা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণে অনুরোধ করেন । ৬ই নভেম্বর বিচারপতি সায়েম বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মোশতাক ও জিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে এবং বঙ্গভবনকে খুনিচক্রের কবল থেকে মুক্ত করে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রক্ষমতায় তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন । সাহসী, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল । মুক্তিযুদ্ধে 'কে' ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে বহুবার সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন । কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন । ৩রা থেকে ৬ই নভেম্বর, মাত্র চার দিনের জন্য তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ৭ই নভেম্বর কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন খালেদ মোশাররফ। পরে খালেদ মোশাররফ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের হত্যা করা হয় ।

 

Content added By

বিচারপতি সায়েমের অকার্যকর সরকার

বিচারপতি সায়েমের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পরের দিন ৭ই নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে যায় । জিয়াউর রহমান গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় টেলিফোনে কর্নেল তাহেরকে অনুরোধ করেন তাঁকে মুক্ত করার জন্য । বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহের মুক্তিযুদ্ধে বোমার আঘাতে একটি পা হারান । জিয়া জানতেন জওয়ানদের মধ্যে তাহেরের বাম রাজনীতির অনেক সমর্থক ছিল । রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য তাহের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকেও এই অভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত করেন । এটি সামরিক বাহিনী ও বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায় । পরিকল্পনা মোতাবেক ৬ই নভেম্বর মধ্যরাতে তাহেরের নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান শুরু হয় । সৈন্যরা জিয়াকে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনলে জিয়া কর্নেল তাহেরকে বুকে জড়িয়ে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানান । কোনো বাধা ছাড়াই সৈন্যরা জিয়াকে সেনাবাহিনীর প্রধান ঘোষণা করে।

জিয়ার ক্ষমতায় ফিরে আসার মধ্য দিয়ে মোশতাকও আশা করেছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হবেন । কিন্তু, জিয়ার সমর্থনের অভাবে মোশতাক ক্ষমতার কেন্দ্রে আর আসতে পারলেন না, রাষ্ট্রপতির পদও ফিরে পেলেন না । বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি পদে বিচারপতি সায়েম থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা ছিল সেনানিবাসে ; সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার হাতে। যে কারণে বিচারপতি সায়েম তাঁর সময়ে কোনো সিদ্ধান্তই স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তা রক্ষা করতে পারেননি। ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান বলপূর্বক আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে নেন। অবশ্য এর অনেক পূর্বেই সায়েমের সরকার অকার্যকর হয়ে পড়ে । নির্বাচন আয়োজনের জন্য তিনি বিচারপতি সাত্তারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার। কিন্তু সাত্তার নির্বাচন আয়োজনে আগ্রহী ছিলেন না, বরং তিনি মেজর জেনারেল জিয়াকে ইন্ধন জুগিয়েছেন ক্ষমতা দখলে । প্রতিদান দিতেও জিয়া কার্পণ্য করেননি । সাত্তারকে তিনি উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

Content added By

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ (১৯৭৫-১৯৮১)

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার দশ দিনের মাথায় ২৫শে আগস্ট জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। পরবর্তীকালে সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানে জিয়া পদচ্যুত ও বন্দী হন। বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়া পুনরায় সেনাপ্রধান হলেও মোশতাকের রাষ্ট্রপতি পদে ফিরে আসাকে সমর্থন জানাননি বরং জিয়া নিজে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর খন্দকার মোশতাক সংবিধান লঙ্ঘন করে নিজে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। এরপর ২৫শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক সেনা বাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে জিয়াউর রহমানকে নিযুক্ত করেন। ৩রা নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাকের পতন ঘটে এবং জিয়া পদচ্যুত ও গৃহবন্দী হন। ৭ই নভেম্বর পাল্টা সেনা অভ্যূত্থান ঘটে এবং জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। লক্ষণীয় বিষয় হলো রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক উভয়ক্ষেত্রেই বিচারপতি সায়েম ছিলেন ক্ষমতাহীন। মূল ক্ষমতা ছিল জিয়ার হাতে। ১৯৭৬ সালের ৩০শে নভেম্বর জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল জিয়া জোরপূর্বক রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। তার শাসন আমলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে অনেকগুলো ব্যর্থ অভ্যূত্থান সংঘটিত হয়। এতে বিচারের নামে জিয়া অনেক নিরাপরাধ সামরিক কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা, চাকরিচ্যুতি, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেন।

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭২-এর সংবিধানে যেসব মৌলিক নীতি ও চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়ে আসছিল, তার বেশিরভাগই জিয়ার সময়ে বাতিল করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গকে তিনি সমাজ ও রাজনীতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন । ১৫ই আগস্টসহ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না মর্মে যে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' প্রণীত হয়েছিল তার মূল হোতাও ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এলে ১৯৯৬ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন' প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক । আর সেই সঙ্গে সুগম হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ ।

৭ই নভেম্বর জিয়াকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী কর্নেল (অব.) আবু তাহেরকে ১৯৭৬ সালে সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচার শেষে জিয়ার আদেশেই ফাঁসি দেওয়া হয়। অবশ্য ২০১১ সালের ২২শে মার্চ হাইকোর্ট সামরিক আদালতে কর্নেল আবু তাহেরের বিচারকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। রায়ে বলা হয়, ঐ সামরিক আদালত গঠন এবং বিচার কার্যক্রমের সবকিছুই অবৈধ।

১৯৭৭ সালের ৩০শে মে জিয়া তার ক্ষমতা বৈধকরণের লক্ষ্যে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করেন। এরপর তিনি নিজস্ব পরিকল্পনা মতো সামরিক ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দল থেকে আদর্শহীন এবং সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠন করেন। এসময়ে রাজনৈতিক দল ভাঙা-গড়ার কাজও চলে। পরিশেষে চাপের মধ্যে ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসনাধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শাসকের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে। সুতরাং নির্বাচনে জিয়াউর রহমান সহজেই বিজয় অর্জন করেন। ইতোমধ্যে সামরিক ছত্রছায়ায় জিয়াউর রহমান গঠিত জাগদল বিলুপ্ত করে প্রথমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন এবং নিজে তার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একতরফা এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জয়লাভ করে। উক্ত সংসদে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ যে সকল সামরিক বিধি, সংবিধান সংশোধনসহ বিভিন্ন অন্যায় ও অবৈধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী অধ্যাদেশ জারি করা হয়, সেগুলো সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে পাস করে বৈধতা দেওয়া হয়। অবশ্য ২০০৮ সালে এক রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়। বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া চালু করে রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের পুনর্বাসন করেন। তিনি সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন করেন। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারের পথ তৈরি করেন। জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের নিজস্ব মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগতকরণ এবং তার অপরাপর কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী ও সুবিধাবাদী সামরিক কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার সাথে যুক্ত আত্মস্বীকৃত খুনিদের গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জিয়া ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের খুবই আস্থাভাজন এবং তিনি এ জঘণ্য হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্বেই অবগত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ার সময় এ সংক্রান্ত আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে এই সময়ে স্বীকৃতি প্রদান করে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা সমর্থনকারী ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহের সঙ্গে এ সময়ে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয় ।

প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা জিয়াউর রহমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। দেশে রাজনীতিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ থাকলেও বড় কোনো আন্দোলন তাকে মোকাবিলা করতে হয়নি। দমন-পীড়ন আর ভয়ভীতির কারণে বিরোধী দল তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি । তবে সামরিক বাহিনীর মধ্যে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে প্রায় সতেরোটি অভ্যুত্থান হয় । প্রতিবার তিনি বিদ্রোহী অফিসারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত শত শত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড এবং চাকরিচ্যুত করা হয় । তারপরও সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেই তার জীবনের ওপর আক্রমণ এসেছে। চট্টগ্রামে ১৯৮১ সালের ৩০শে মে সার্কিট হাউসে এক অভ্যুত্থানে তাকে হত্যা করে কতিপয় সেনাসদস্য ।

Content added By

বিচারপতি সাত্তারের সরকার

রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ উপস্থিত থেকে ৭৮ বছর বয়স্ক সাত্তারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন । সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে । ১৯৮১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয় ।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তারকে মনোনয়ন দেয় । কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতির লাভজনক পদে থাকায় নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না । সংসদে বিএনপির সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ষষ্ঠ সংশোধনীর মাধ্যমে ঘোষণা করা হলো উপরাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় । সুতরাং বিচারপতি সাত্তারের নির্বাচন করার আর আইনি বাধা থাকল না। সেনাপ্রধান লে.জেনারেল এরশাদ অতিমাত্রায় আনুগত্য দেখাতে গিয়ে ঘোষণা দিলেন যে, সেনাবাহিনী নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তারের পক্ষে থাকবে । নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। বিএনপি প্রার্থী সাত্তার সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ নির্বাচনী প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে । বিরোধী দল নির্বাচনে কারচুপিরও অভিযোগ তোলে ।

নির্বাচিত হয়ে বিচারপতি সাত্তার ২৮শে নভেম্বর ১৯৮১ বিয়াল্লিশ (৪২) সদস্যের বিশাল মন্ত্রিসভা গঠন করেন । কিন্তু, জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপির মধ্যে দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করে । এর সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে সাত্তারের জন্য প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে পড়ে । সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বিচারপতি সাত্তার মাত্র সাড়ে তিন মাসের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন । এসব করেও তিনি শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ হন । সেনাপ্রধান এরশাদ বলপূর্বক নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন । অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ থেকে সামরিক আইন জারি করে বলেন 'দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে এবং সামরিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংকট হতে জনসাধারণকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে হয়েছে।' অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীরা এমন নানা অজুহাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করে । গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এরশাদ ১৯৮২- ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শাসনকালে জনসাধারণকে সংকটমুক্ত করার পরিবর্তে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করেছেন ।

Content added By

সামরিক অভ্যুত্থানঃ জেনারেল এরশাদের সরকার

লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করে ১৯৯০ সালে পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেন । ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আর ১৯৮৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন রাষ্ট্রপতি। এরশাদ অল্প সময়ের জন্য বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে (২৭শে মার্চ, ১৯৮২ থেকে ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৮৩) রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত রাখেন। সুবিধাজনক সময়ে তাঁকেও অপসারণ করতে দ্বিধা করেননি । একই সাথে এরশাদ জাতীয় সংসদ বাতিল করেন ।
 

প্রশাসনিক সংস্কার:

লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে বেসামরিক প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন । তিনি ১৯৮২ সালের ২৮শে এপ্রিল প্রশাসনিক পুনর্গঠন কমিটি গঠন করেন । এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে তিনি প্রশাসনিক কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন করেন ।

ক. উপজেলা ব্যবস্থা : থানা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। উপজেলায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অধীনে সরকারি আমলাদের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালিত হবে। ১৯৮২ সালে ৭ই নভেম্বর ৪৫টি থানাকে উপজেলা করার মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থার যাত্রা শুরু । পর্যায়ক্রমে ৪৬০টি থানা উপজেলায় পরিণত হয় । ১৯৮৩ সালে ১৪ই মার্চ থানার পরিবর্তে উপজেলা নামকরণ করা হয় ।

খ. মহকুমাকে জেলা ঘোষণা : প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের জন্য মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে মোট ৬৪টি জেলায় ভাগ করা হয় ।
 

গ. বিচার ব্যবস্থার সংস্কার : বিচার ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। উপজেলায় পৃথক ম্যাজিস্ট্রেট ও মুন্সেফ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয় । এছাড়া রংপুর, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় । কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে ঢাকার বাইরের বেঞ্চগুলো বাতিল করা হয় ।

এরশাদ শিক্ষা, কৃষি, ভূমি, ঔষধনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন । কিন্তু নীতিগুলোর জনবিরোধী ধারার কারণে সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়নি । কারণ প্রকৃত সুফল জনগণ পায়নি । এরশাদ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ব্যাপকহারে নিয়োগ দিতে শুরু করেন। উদ্দেশ্য- সরকারি আমলাতন্ত্রের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা ।

 

উন্নয়ন কর্মকাণ্ড:
এরশাদ নানাভাবে নিজেকে একজন জনদরদি নেতা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। সভা-সমাবেশ ও সরকারি প্রচার মাধ্যমে বলা হয়েছে এরশাদের উন্নয়ন কর্মসূচির লক্ষ্য গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন ১৯৮৩ সালের ১৭ই মার্চ তিনি জনগণের সার্বিক কল্যাণে ১৮ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন । জাতীয় সংহতি থেকে শুরু করে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থানসহ পররাষ্ট্রনীতি পর্যন্ত সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
সরকারি টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্রে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রচারণা চালানো হলেও সামগ্রিকভাবে তার আমলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক ছিল না । প্রকৃত উন্নয়ন না হওয়ার প্রধান কারণ দুর্নীতি আর সীমাহীন লুটপাট । এরশাদের সময়ে বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা হতাশাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণখেলাপি সংস্কৃতিতে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও দলছুট রাজনীতিবিদরা লাভবান হয়েছেন । খাদ্য উৎপাদন, জিডিপি, গড় প্রবৃদ্ধি সব ছিল নিম্নগামী। তবে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে । কারণ নিজের ক্ষমতার ভিত শক্তিশালী করার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে সামরিক বাহিনীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছিলেন।

 

বৈদেশিক সম্পর্ক:
বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদ নতুন কিছু করেননি । তিনি পূর্বের সরকারের পথই অনুসরণ করেন । ভারতের বিপরীতে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক আরও দৃঢ় করার উদ্যোগ নেন। বিশেষভাবে সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্রের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায় । পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরাকসহ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। তবে তিনি অতিমাত্রায় মার্কিনপন্থী ছিলেন । মার্কিন সরকারকে সন্তুষ্ট করার জন্য ঢাকা থেকে সোভিয়েত কূটনীতিককে বহিষ্কার করেন । ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরশাদ উত্তেজনা পরিহারের চেষ্টা করেন। তিনি ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেননি । বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরশাদের একটি বড় সাফল্য হলো সার্ক গঠন। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে একত্রিত করে প্রতিষ্ঠা করেন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)। এই সংস্থার প্রথম শীর্ষ সম্মেলন ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় । 

 

গণভোট:
সামরিক শাসকদের গতানুগতিক প্রথা অনুযায়ী এরশাদও বলপূর্বক ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য গণভোটের আয়োজন করেন । এরশাদ রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার কারণে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হন । অবশেষে ১৯৮৫ সালের ২১শে মার্চ গণভোট অনুষ্ঠিত হয় । স্বাভাবিক কারণেই সাধারণ জনগণ এই নির্বাচনে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তারপরও জেনারেল এরশাদ প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৯৪ দশমিক ১৪ ভাগ ভোট লাভ করেন । সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের কারসাজির মাধ্যমে তার পক্ষে বিপুল ভোট দেখানো সম্ভব হয়।

 

রাজনৈতিক দল গঠন:
ক্ষমতা দখলকে পাকাপোক্ত করার জন্য এরশাদ একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন । ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে ‘জনদল' নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন । এই দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ, নতুন বাংলা যুব সংহতি, নতুন বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন ইত্যাদি । সুবিধাবাদী, দলছুট বিভিন্ন নেতাকর্মী নিয়ে জনদল গঠিত হয়। এরপর তিনি ১৯৮৫ সালের ১৬ই আগস্ট প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় ফ্রন্ট। জনসমর্থনহীন কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতা ফ্রন্টে যোগ দেন । অবশেষে, ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’র যাত্রা শুরু হয় ।

 

নির্বাচন:
১৯৮৬ সালের ৭ই মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে এরশাদের জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামীসহ মোট ২৮টি দল অংশগ্রহণ করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে । নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ এককভাবে ৭৬টি আসন লাভ করে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় আসন গ্রহণ করে । নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল এরশাদের বিরুদ্ধে মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ উত্থাপন করে । পর্যবেক্ষকগণও এ অভিযোগের যথার্থতাকে সমর্থন করেন । ১৯৮৬ সালের ১৫ই অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে । প্রহসনমূলক এ নির্বাচনে এরশাদকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয় ।

 

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম:
লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর শাসনামলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন । মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশে এরশাদ এই সংশোধনী আনেন । বলার অপেক্ষা রাখে না ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ।

 

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন:
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ, আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল মোকাবেলা করেছেন লে. জেনারেল এরশাদ । ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । যে কারণে এরশাদ বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন । এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন জোট গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৮ দলীয় জোট ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে বাম সংগঠনের ৫ দলীয় জোট গড়ে ওঠে (যা পরে ১৫ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়)। অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট গড়ে ওঠে।

আন্দোলন দমনে লে. জেনারেল এরশাদ দমন, পীড়ন, অত্যাচার ও হত্যার পথ বেছে নেন। ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের ট্রাক তুলে দেওয়া, সরাসরি গুলি করার ঘটনাও কম হয়নি । ১৯৮৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে জাফর ,জয়নাল, মোজাম্মেল নিহত হন; বহু নেতাকর্মী আটক হয় । ছাত্র আন্দোলন দমনে এরশাদের নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করে । ১৯৮৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি এরশাদের ছাত্র সংগঠনের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাউফুন বসুনিয়া নিহত হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ২২টি ছাত্র সংগঠন মিলে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ । ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো উপলব্ধি করে যে, এরশাদের বিরুদ্ধে অভিন্ন কর্মসূচি ছাড়া আন্দোলন সফল হবে না । উল্লেখ্য ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর থেকেই এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দল, সাধারণ জনগণ এবং নাগরিক সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । এরশাদের পদত্যাগ ও একটি অর্থবহ নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দল দুর্বার গণআন্দোলন শুরু করে । ১৯৮৭ সালে সংসদ থেকে একযোগে বিরোধী দল পদত্যাগ করলে ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় । ১৯৮৮ সালের ৩রা মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয় । আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে । ভোটারবিহীন, দলবিহীন এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন পেয়ে বিজয়ী হয় । সরকার অনুগত আ.স.ম. আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী জোট (কপ) পায় ১৯টি আসন। বাকি আসনের ৩টি জাসদ (সিরাজ), ২টি ফ্রিডম পার্টি এবং ২৫টি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান ।

 

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও এরশাদের পতন:

দীর্ঘ ৯ বছরের প্রায় পুরো সময়টা জনগণ লে. জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে । আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কৃষক সংগঠনসহ এরশাদবিরোধী চেতনা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায় । হরতাল- অবরোধে প্রশাসনে একপ্রকার স্থবিরতা দেখা দেয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর বুকে ও পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক' লেখাসহ ঢাকার জিপিও'র কাছে, জিরো পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হন। এতে জনগণ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ।

১৯৮৭ সালের ১২ই নভেম্বর শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে এবং ২৭শে নভেম্বর এরশাদ সরকার দেশে জরুরি অবস্থার ঘোষণা দেয়। ১৯৮৮ সালের ২৪শে জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার এক সমাবেশে নির্বিচারে জনতার ওপর গুলি চালায়, অল্পের জন্য শেখ হাসিনা রক্ষা পান । এর বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে । ১৯৯০ সালের ১০ই অক্টোবর বিরোধী জোট ও দলগুলোর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করে তোলে । এদিন মিছিলে গুলিবর্ষণে ৫ জন নিহত এবং তিন শতাধিক আহত হয় । ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরে ওই বছরই ২৭শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে অজ্ঞাতনামা আততায়ীর গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ ধারণ করে। ২৭শে নভেম্বর সরকার জরুরি অবস্থা ও কারফিউ জারি করে। ২৭শে নভেম্বর সাংবাদিকরা সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলিতভাবে মিছিল বের করে কারফিউ ও জরুরি আইন অমান্য করেন । রাজপথ চলে যায় জনতার দখলে। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের শহরে। এ অবস্থায় বিরোধী রাজনৈতিক ৩ জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয় । ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর তাঁর কাছে এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন । ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতনের ফলে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে ।

Content added By

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাঃ গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রভাব-সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা

অভ্যুদয়লগ্নে বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত উন্নয়নশীল দেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অদম্য মনোবল, অসীম সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা নিয়ে তিনি দেশ পুনর্গঠণ শুরু করেন। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে এদেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়া হয়। এরপর চলে দীর্ঘদিনের সামরিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। দীর্ঘ একুশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে আবারও দেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে বদ্ধপরিকর হয়। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বিশ্বশান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করতে তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশু মৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেবার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু জন্মহার ও মৃত্যুহার কমানো, দরিদ্রমানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম ।

 

অর্থনৈতিক উন্নয়ন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। এ ছাড়াও পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহের মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নয়নকে গতিশীল রাখা হয়েছে। একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশগঠনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বান, 'আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

 

খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন: বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বিশেষত দরিদ্র মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তি ও পুষ্টির জন্য প্রণীত হয় ‘খাদ্য নীতি-২০০৬'। সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুঃস্থ ভাতা, পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অসহায়দের জন্য ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী, ভর্তুকি মূল্যে খোলা বাজারে খাদ্য পণ্য বিক্রি, ভিজিডি, ভিজিএফ, টেস্ট রিলিফ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সহায়তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে।

 

শিক্ষায় অবদান: শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সরকার শতভাগ ছাত্র-ছাত্রীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১। বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭০ ভাগে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষে “শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২' প্রণয়ন করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট” ।

 

স্বাস্থ্য সুরক্ষা: স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১'। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে নতুন ১২টি মেডিকেল কলেজ । শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ ।

 

নারীর ক্ষমতায়ন: নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১'। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ।

 

‘জাতীয় শিশু নীতি ২০১১' প্রণয়ন: “জাতীয় শিশু নীতি ২০১১' এর মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দুঃস্থ, এতিম, অসহায় পথ-শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের সাউথ-সাউথ এওয়ার্ডে ।

 

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন: ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে এবং তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫৪ টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার'। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০। দেশের সবক'টি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায় । বর্তমান সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর সবচেয়ে সুবিধাভোগী গ্রুপ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ক্লাস, পরীক্ষা, শিক্ষা উপকরণ ছাড়াও পারস্পরিক যোগাযোগ, ডিজিটাল পরিবহন সুবিধা, সরকারি বেসরকারি ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রমে অনলাইন সুবিধা, সেমিনার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সভা-সমিতি, অর্থাৎ যাপিত জীবনের সবকিছু অনলাইনে সম্পাদন করার বিষয়টি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে ।

 

কৃষিতে অনন্য অবদান: কৃষিখাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্সিং।

 

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন: বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লক্ষেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর খ্যাতি ও সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে।

 

রপ্তানি শিল্পে অবদান: বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি আবাসন, জাহাজ, ঔষুধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য শিল্পের প্রসার ঘটেছে; রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ঔষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী। বাংলাদেশের আইটি (IT) শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম কুঁড়িয়েছে ।

 

মানবিক রাষ্ট্রে উত্তরণ: বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও প্রশংসিত। কথিত তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেবার পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র, , চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, দৃঢ়চেতা, সাহসী ও মানবিক নেতৃত্বের কারণে ।

 

আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন: দেশ আর্থ-সামাজিক সূচকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যাশাজনক সাফল্য অর্জন করেছে। এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ এখন মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজ অব্যাহতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নিজস্ব অর্থে পদ্মা নদীর ওপর ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করার সাহস ও সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ ।

 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগও চলমান। মহাকাশ জয়ের লক্ষে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১' মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে বাংলাদেশ 'ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড' গঠন করা হয়েছে।

 

বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতি: যুদ্ধ-সংঘাত বা বৈরিতা ছাড়াই দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে সমুদ্র-বিজয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে স্থলসীমান্ত চুক্তি হয়েছিল সম্প্রতি তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন।

 

 

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা: সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষায় পরিণত হবে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য এ দেশের ছাত্র ও সাধারণ মানুষ রক্ত দিয়েছিল, আজ সে দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। এটি আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য বড় অর্জন । বাংলাদেশের বাংলা বর্ষবরণ উদযাপনে যে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় তা ‘ইনট্যানজিবল হেরিটেজ' হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ফলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের কারণে।

 

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:  পিপলস অ্যাণ্ড পলিটিকস, বিশ্বের পাঁচজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি, বিদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মতো কোনো সম্পদও নেই। বিশ্বের সবচেয়ে সৎ এই পাঁচজন সরকার প্রধানের তালিকায় আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কল্যাণমুখি অবদানের জন্য তাঁকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সরকার পরিচালনা ও নেতৃত্ব প্রদান, জনগণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় শেখ হাসিনা একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আর তাই মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক খালিজ টাইমস, রোহিঙ্গাদের সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাঁকে ‘নিউ স্টার অব দ্য ইস্ট' বা ‘পূর্বের নতুন তারকা' হিসেবে আখ্যায়িত করে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাঙালির জীবন-যাত্রার মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করতে শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

Content added By
Promotion